Dita Basu - <!-- -->Bengali Work : A childhood trip -- Himalaya on foot

Bengali Work : A childhood trip -- Himalaya on foot


2911E86F-7039-472C-A319-D1E223288019

'কইতে কী চাই কইতে কথা বাধে হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে'

বাবাও গলা মেলালেন আমার সঙ্গে। দূরে, হিমালয় পাহারের চূড়ায় রঙের হোরি খেলা। সূর্য চলেন অস্তাচলে।

কমলা আলো পাহাড়ের কোলে মুখ দেখিয়ে দেখিয়ে টুকী খেলায় মেতেছে। একটু দূরে একটা বড় কালো পাথরেরর পিছনে সাদা রঙের ফুল দোল খাচ্ছে। ঠিক যেন একটা সাদা বক পাখা মেলে উড়তে যাবে। ছোট্ট খেলার মিনিয়েচার বক। অমনি ডানা, অমনি লম্বা চোঁচ।

আমি ধরতে যাই নিচু হয়ে।বাবা আমাকে ফ্রক ধরে টেনে তোলেন। ঠিক বিল্লি বাচ্চাকে মা বেড়াল যেমন ঘাড় ধরে তুলে নেয়।

"একটা ফুল নিলে কী হয়, বাবা?"

তিনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারিনা সে দৃষ্টির অর্থ। আমার ওপর বিরক্তি, না অন্য কিছু? তারপর বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমি একটু হকচকিয়ে যাই।

"ওঃ কাল কী হচ্ছিল? আরেকটু হলেই তো..". তাঁর গলার হাড়টা ওঠা নামা করে। "মৃত্যুর গভীর খাদ।"

তাহলে গল্পটা খুলেই বলি। সেই রাতে আমি নাকি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। কিন্তু আমি তার কিছুই জানতে পারিনি।


গরমের ছুটিতে আমরা কেদার বদরী বেড়াতে যাচ্ছি। আমার বয়স বারো, আমার ভাই রানার বয়স নয়; মা, বাবা, আর মেজো পিসিমা -- এই নিয়ে আমাদের পারিবারিক দল। আমার বাবা আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন কেদারবদরীর তীর্থে। এতে অনেকে ভয় দেখিয়েছে। আবার অনেকে দিয়েছে উৎসাহ। মনে আছে আমরা কথা দিয়েছি পায়ে হেঁটে এগারো দিনে একশ মাইল যেতে আমরা প্রস্তুত। "ঠিক তো!"

কেনা হয়েছে নতুন কেডস জুতো আর লাঠি।

হৃষীকেশ থেকে বাসে করে আমরা কুণ্ড চটি অবধি এসেছি। গা- বমির জন্য আমাকে দেওয়া হয়েছে 'এভমিন' ট্যাবলেট। ফলে সারা রাস্তা আমি ঘুমতে ঘুমতে আর বাসের জানলায় ঠোক্কর খেতে খেতে এসেছি আগের দিন।

কুণ্ড চটিতে নেমে 'ডগ টায়ার্ড' সবাই যখন কোনমতে লেপের তলায় বডি ফেলেছেন আমি নাকি তখন বাইরে বেরিয়ে যাই। চটি, মানে সরাইখানা গুলির বাইরেই থাকত বাথরুমের ব্যবস্থা। এই সময়ে ঘুম চোখে, দিক ভুল করে আমি নাকি গভীর খাদের দিকে চলে যাচ্ছিলাম। এক পলকের জন্য বাবা আমাকে দেখতে পেয়ে বাঁচিয়ে ছিলেন।

আমার মনে কোন আতঙ্ক বা ভয়ংকর অনুভূতির আভাস সেদিন ও ছিলনা। আজও নেই স্মৃতিতে। কিন্তু পিতৃ-হৃদয় যমের যে রূঢ়, রুদ্র মূর্তির ঝিলিক দেখেছিলেন ঐ অন্ধকার রাতে আজ নিজে মা হয়ে বুঝতে পারি তার বিভীষিকা ।


"কী হয় বাবা একটা ফুল নিলে? দেখ কেমন উড়ন্ত সাদা পাখির মত ফুল?" বাবা বলেছিলেন, "ও স্বর্গের ফুল। পারিজাত। ও ফুল ছিঁড়ে তুলতে নেই। শুধু চোখ ভরে দেখে নিতে হয়।"


অনেক পরে, বড় হয়ে জেনেছিলাম ওরা অর্কিড বিশেষ। দেখেছিলাম বিদেশের এক অর্কিড শো তে।ইংরিজি নাম হাবেনারিয়া। যদিও ট্যাগে বলা হয়েছে ওদের অরিজিন মূলত জাপান ও চীনে, ও ফুল তো আমি দেখেছি হিমালয়ের বনে।


এতক্ষণ নদী বইছিল আমাদের বাঁ দিকে, এবার কুণ্ড চটি থেকে তা বাঁক নিল দক্ষিণে।মন্দাকিনী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। ছোট ছোট নুড়ি, পাথরের সাথে বকবক আর খিলখিল হাসিতে। নদীর নাম পালটে যায় শুনলাম এ পথে। মহাদেবের জটা থেকে নেমেছে নানান বেণী। কোথাও তার নাম অলকানন্দা, কোথাও মন্দাকিনী। সেই একই গঙ্গা।

আমাদের বড় দলে আছেন অনেকে। একজন আছেন তাঁকে রানা আর আমি নাম দিয়েছি ‘শিশি পিসি'। তিনি সব কটি নদী থেকে, সব কটি ঝোরা থেকে জল সংগ্রহণ করেন। রাখেন হোমিয়প্যাথির শিশিতে। মাঝে মাঝে বাক্স খুলে আমাদের দেখান। আমরা চমৎকৃত হই ওঁর শিশি সংগ্রহের কৌশলে। আর আমাদের ঐ অবাক দৃষ্টি টাই ওঁর পুরস্কার। ভরিয়ে দেয় ওঁর মুখ একগাল পান খাওয়া হাসিতে।

শিশি পিসির আরেক নাম ছিল বড়দের মধ্যে --'এক্সপ্রেস'।কারণ এক্সপ্রেস গাড়ির মত উনি পৌঁছতেন প্রায় সবার আগে পদব্রজীদের মধ্যে। না, দু একজন অবশ্য তাঁকে হারাত, তাদের কথা আসছে পরে।

দিনে আট দশ মাইল হেঁটে আমরা সন্ধ্যের মুখে পৌঁছতাম চটিতে মানে সরাইখানা বিশেষ। আমাদের আগেই পৌঁছে যেত ট্যুর কোম্পানির হেল্পার রা। বড়রা চা খেতেন। আমাদের জন্য থাকত গরম দুধ, চকোলেট বা মল্ট মেশান। কোনদিন থাকত সিঙ্গাড়া,কচুরি, কোনদিন মুড়ি বা চিঁড়ে ভাজা। রাতে ভাত আসার আগেই আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম।

বিজলী বাতি ছিলনা। চটিগুলো নিতান্তই সাধারণ মাটির বাড়ি। একটাতে আমরা বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিলাম। রানা ও আমার যে বিশেষ রোমাঞ্চ হয়েছিল তা মনে আছে।

এক ঘরে আমরা দশ বার জন শুতাম। মাটিতে ঢালাও চাটাইয়ের ওপর হোল্ডলে পাতা বিছানা। সকাল হলেই আবার ওয়াটার- প্রুফ চাদরে মুড়ে, নাম লিখে বিছানা জমা দিতে হত। গাধার পিঠে যেত পরের চটিতে।

লন্ঠন জ্বলত টিমটিম।কিন্তু তারও আগে কোন এক বৃহস্পতি বার শিশি পিসি বার করলেন তাঁর ঝুলি থেকে একটি ছোট পট। ও তার সামনে বসে দুলে দুলে গানের সুরে পড়তে লাগলেন ব্রত কথা -- “বৈকুণ্ঠে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ণ করিতেছেন কত কথা হইয়া মগন।”

নিতাই ট্রেতে করে চা আর পাঁপড় ভাজা নিয়ে ঢুকলে সবাই সজাগ হয়ে উঠে বসে।শিশি পিসি একবার পিছন ফিরে দেখলেন।

“অ নেতাই আমাকে পরে একটু চা গরম করে দিস বাবা।" এ পাশে চৌধুরী কাকিমা মা কে গলা খাটো করে,” আচ্ছা, বলতো ভাই কী অন্যায় আব্দার, ওরা কী মানুস নয়?”

ঘড়ি ঘড়ি চা গরম করা যে কী ঝামেলার তা মা মাসিরা আর যারা হেঁশেল সামলায় সবাই জানে। কিন্তু একদন্ত দাদু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে ওঠেন।

একদন্ত দাদুর কথা বলা হয়নি।ওঁর একটাই দাঁত অবশিষ্ট ছিল।হাসলে কেবল তা ই দেখতে পেতাম আমরা। মানুষটা ছিলেন লম্বা,মাথায় টাক। একটু ঝুঁকে হাঁটতেন। এককালে যে রোদে পুড়ে অনেক খেটেছেন গায়ের তামাটে রঙ তার সাক্ষর দেয়। দাদু ধার্মিক মানুষ। তিনি বাবু হয়ে কোলের ওপর হাত দুটি জুড়ে শুনছেন। হয়ত দিদিমা যখন বেঁচে ছিলেন এমন করেই শুনতেন। পাশে ধূমায়িত চা ঠাণ্ডা হয়ে সর ভাসায়। শিশি পিসি ততক্ষণে প্রায় শেষে এসে পৌঁছেছেন — “ জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়ণী, তোমার কৃপায় শেষ করিনু পাঁচালী।” গড় হয়ে প্রণাম করে সবাই।

এতক্ষণে আরেক রাউনড চা এসে গেছে। ঘরের ও দিকে কাকুরা তাসে বসেছেন। চৌধুরী কাকু, ডাক্তার কাকু, বিনয় কাকু, আর হুঁকো দিদিমা। চৌধুরী কাকু চেঁচিয়ে ওঠেন,“হরতনের টেক্কা।”

ঘরে একটা মিষ্টি গন্ধ। হুঁকো দাদুর হুঁকো থেকেই বোধহয়। মাঝে মাঝে ভুরুক ভুরুক শব্দ।

আর ছিল বারিন জেঠু।জেঠু মোটা সোটা ভারিক্কি চেহারার মানুষ।সব সময়ে একটা বোঁচকা নিয়ে ঘুরতেন। তাতে থাকত নানা রকম ওষুধ বিসুধ।কারো কোন অসুখ বা অসুবিধা হয়েছে শুনলেই জেঠু তৎপর হয়ে উঠতেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ- ডাক্তার কাকুর আগে যেন তিনি খবরটা পান। “তোমার মাথা ধরেছে? এই নাও স্যারিডন।অ্যাঁ, মাধুরীর পায়ে ব্যথা? এই মলমটা লাগাক না। আরে এগুলো আনলাম কেন বয়ে, অ্যাঁ? কোন কাজেই যদি না লাগে?”

বারিন জেঠুর মুখ খানা দেখলেই আমার বাড়িতে ফেলে আসা মা’র পিতলের গোপাল ঠাকুরের মুখ মনে পড়ত। অমনি গোল, চকচকে মুখে আয়ত টানা টানা চোখ, আর অমন বাঁশির মতন নাক। একটা বড়, অ্যাডাল্ট মানুষের যে অমন গোপাল ঠাকুরের মত মুখ হতে পারে এটা আমার খুব অবাক লাগত। তবে একথা আমি কাউকে বলিনি।

বারিন জেঠুর সাথে রানার বিশেষ ভাব। জেঠু কনফারমড ব্যাচেলর, কিন্তু ছোটদের খুব ভাল বাসতেন। তাদের অসংখ্য 'কেন?' 'কি করে?','কই দেখি তো’? তে ক্লান্ত হতেন না।

রানা তাঁর সঙ্গেই শুত।আর রানার পাশে আমার বিছানা। ঘুম না আসা অবধি জেঠু যে কত গল্প বলতেন। তাঁর মুখে কাউনট অফ মনটে ক্রিস্তো এক আশ্চর্য রূপ নিত।সব যে বুঝতাম তা নয়, কিন্তু এডমণ্ড দান্তে, একটা নির্দোষ লোক কে কোন কারাগারে বন্দী করে রাখা হল, জেঠুর গলায় —"রাতে জেলের দেয়ালে ঠুক ঠুক,ঠুক ঠুক!” একটু চুপ থেকে মুখটা কাছে এনে -”দান্তে শুনত ও পাশ থেকে, ঠুক ঠুক!” গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। এর পর আসবে পাদ্রীর সঙ্গে এডমণ্ড দান্তের পরিচয় ইত্যাদি। সে সব ভুলেই গেছি কিন্তু সেই পাথরের দেয়ালে ‘ঠুক ঠুক’ শব্দ নিয়ে চোখ বুজতাম।

হঠাৎ কানে আসত ভাইয়ের গলা -“কিন্তু জেঠু ঐ যে তুমি বলেছিলে দান্তে মরেও মরেনি?” একই গল্প আমরা বার বার শুনতাম। উনি ভুলে গেলে আমরাই আবার ধরতাই দিতাম। “মরেনি ই তো। কী হয়েছিল জান?” তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠত। “ ভ্যাম্পায়ার! সে একটা আজীব জীব - আসলে মরেনি। প্রতিহিংসার জন্য রক্ত লোলুপ।” আঙুলের মুঠি খুলে বন্ধ করে জেঠু গলা ভারি করে বলতেন, “'রক্ত চাই! রক্ত খাব!’ বলে বলে ঘুরত।”

বারিন জেঠুর গল্প-যাদুতে অনেকেই পাশ ফিরে হাতে ভর দিয়ে কান করে শুনত। “হ্যাঁ, প্যারিসে যেখানে সেখানে সেই ধনকুবের, অদ্ভুত মিসটিরিয়াস কাউনট অফ মন্তেক্রিস্তোকে দেখা যেত তো।” তারপর একটু থেমে, "কিন্তু কিছু খেতেই তাকে কেউ কখনো দেখেনি। রাতের বেলায় আসত। নাঃ, দিনের বেলায় কেউ কোনদিন দেখেনি।"


পরদিন হাঁটার পথে আমরা একটা নতুন গান গাইতাম লাঠি ঠুকে ঠুকে, তালে তালে, “এডমণ্ড দান্তে, বরন অন মানডে ক্রিসচিনড অন টুইস ডে…"

'পাহাড় কো পাহাড় কো!’ মানে পাহাড়ের দিকে সরে হাঁট। গাধার ওপর মাল, ডান্ডি বা কান্ডিতে চড়ে মানুষ যেত। তাদের পথ দিতে হত।

একটাই পথ। প্রতি পথের বাঁকে আলাদা রূপ, আলাদা ছবি। সবাই এক সঙ্গে বেরলেও নিজের গতি, নিজের ‘পেসে' হাঁটত। মেজ পিসিমার নাম হয়েছিল ‘মেল’ কারণ তিনি এক্সপ্রেসের ঠিক পরেই পৌঁছতেন।

মেজ পিসিমা একদিন আমায় বলেছিলেন,”বুঝলি, আমার সমস্যা হল উৎরাই। চড়াই উঠতে তো আমার কোন অসুবিধাই নেই।” এমন অদ্ভুত লেগেছিল শুনে।

রানা তিড়িং বিড়িং করে এগিয়ে যেত। অনেক সময়ে পাকদণ্ডী পথেও। এবং কোথায় কোথায় বিপদ তা নাকি সাঙ্কেতিক ভাষায় বাবাকে নির্দেশ দিত। বাবা নাকি দেখেছেন। আমি ভাবতাম, "যত্তসব !”

আমার ভাইয়ের উদ্যম আমার ছিলনা। সে বারিন জেঠুকে ছেড়ে ধরত বিনয় কাকুকে।বিনয় কাকু হলেন আমাদের এ ট্যুর কোম্পানির ম্যানেজার। তিনি প্রায় সবার পরে বেরতেন আর সবার আগে পৌঁছতেন।


আগেই বলেছি রানার মত উদ্যোগ আমার ছিলনা। মাঝে মাঝে নেতিয়েও পড়তাম। তখন বাবা ফ্লাস্ক খুলে গরম দুধ দিতেন আর তাতে ওষুধের মত গন্ধ মেশান থাকত। আবার খানিক দম পেতাম।

গৌরী কুণ্ড বলে একটা জায়গায় পেলাম গরম জলের উষ্ণ প্রস্রবণ।অনেকেই জামা কাপড় খুলে জলে নামলেন। জামা কাপড় খোলা ব্যাপারটার জন্যই আমি অনেকক্ষণ দোনামনা করলাম। কিন্তু নেমে বড় আরাম পেলাম। আর তখন উঠতে ইচ্ছে করেনা।

এদিকে তখনও অনেকটা পথ বাকি। অনেকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। জামা কাপড় গুলো অল্প না শুকালেও মুশকিল। তাই একটু থেমে যেতেই হয়। কখন যেন পাথরের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।

কানে এল এক আশ্চর্য আওয়াজ। লোকজনের কথার আড়ালে যা চাপা পড়ে গেছিল। এখন সব চুপ।

পাথরের গা বেয়ে নেমেছে ঝর্না।প্রপাতের মত খাড়া। তলা দিয়ে জল চলছে, ওপরে বরফ। তার ই শব্দ।

একটু দূরে মা’র গলার গানের সুর.— “ তোমার এ ই ঝরনা তলার নির্জনে, মাটির এই কলস আমার…"

গৌরী কুণ্ড ছাড়িয়ে পড়লাম এসে একটা ছোট গ্রাম-বাগানে। নাম ‘জুরানি।' সেখানে আমরা কমলা লেবুর রস খেয়েছিলাম। বাবা বললেন,”আরেকটা দিন তো , আমার ছেলেটার জন্য নিয়ে যাব।”

“আপকা বেটা?” হাত দেখিয়ে মাপ দেখাল দোকানি,”লাল সোয়েটার, লাল টোপী ছোটা-মোটা টেনজিং সাব?” এক গাল হেসে,"উয় তো পিয়া হ্যা।লেকিন লে যাইয়ে।” সে বাবাকে এমনিই দিল। কিছুতেই পয়সা নিল না।


এই পথে প্রচণ্ড চড়াই ভেঙ্গে গিয়ে পড়লাম যে জায়গায় তার নাম ‘মুণ্ডকাটা গণেশ।’ সে মন্দিরে আমরা যাইনি শুনে একদন্ত দাদুর সে মুখ খানি আমি আজও ভুলিনি। “যাঃ!" আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মুণ্ড কাটা গণেশের গল্প জান তো? এই সে পবিত্র স্থান।” দাদু চোখ ঘোরালেন।

“জানিনা।" মাথা নাড়ি।তিনি বাবার দিকে তাকালেন, যেন,”কী করতে তীর্থের নামে এদের নিয়ে এসেছেন?”

বারিন জেঠু কে ধরলাম। মুণ্ড কাটা গণেশের গল্প বলতে হবে।জেঠুর অভিনয় ক্ষমতায় আর অভিনব গল্প বলার কৌশলে সে গল্পও মনে খোদাই হয়ে আছে।


"আর পারিনা।” হাঁফ ছাড়ে পদযাত্রীর দল।

”আর কত দূর?” জিজ্ঞেস করি আমরা ফিরতি যাত্রীদের। ওরা এখন উৎরাইয়ের পথে, দ্রুত পায়ে নামে , হাসতে হাসতে বলে,”জয় কেদার! এইতো বাঁক ঘুরলেই।" কত বাঁক ঘুরি। কোথায় পথের প্রান্ত?

বাবা কে বলি,” কেন ওরা এমন মিথ্যা কথা বলে? এদিকে তীর্থ করতে এসেছে!”

চড়াইয়ের পথ। বাবা দম নিয়ে একটু হাসেন। উত্তর দেন না। ওয়াটার বটল থেকে এক ঢোঁক খান। আমাকেও দেন।

শেষ চটি রামওয়ারাতে পৌঁছে আমরা সবাই অল্প বিস্তর কাবু। আর মাত্র তিন মাইল পথ বাকি। কিন্তু এ তিন মাইল কিলার হিল। বিনয় কাকু বারবার সাবধান করেন। ডাক্তার কাকু সে রাতে অনেকের ব্লাড প্রেশার মাপলেন । পরদিন সকালেও আবার। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। নাক বন্ধ। যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।

হুঁকো দাদু মুড়ি সুড়ি দিয়ে শয্যা নিলেন।”আমি যামুনা।”

"একি, এদ্দুর এসে শেষ যাবেন না ? ঠিক পারবেন উঠুন। ডান্ডি করে যাবেন।” সবাই উৎসাহ দেয়।

“নাঃ!" দাদু মুখ ফিরিয়ে শুলেন।

এই পথের আরেকটি বিশেষ চরিত্রের কথা বলতে ভুলেছি। ছি,ছি কী করে ভুলে গেলাম? তিনি হলেন পাণ্ডাজী।

প্রতি বছর বসন্ত কালে সকালবেলা ব্রহ্মকমল ফুল আর প্রসাদী মিষ্টি নিয়ে তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। দুপুরে খেতেন ।মা নিজে হাতে রান্না করে পরিবেশন করতেন। বিশ্রাম করে চলে যেতেন বিকাল বেলায়। এ হেন পাণ্ডাজী ছিলেন আমাদের বংশানুক্রমিক পাণ্ডা। আমার ঠাকুমাকে দেখিয়েছেন কেদার, নিয়ে গেছেন অমরনাথ। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার মায়ের দাদুকে এঁর বাবা নিয়ে গেছেন অনেক তীর্থের পথে। অতএব এঁদের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় আমাদের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক।

কোন চটি থেকে যে তিনি আমাদের সঙ্গ নেন সেটা আর মনে নেই কিন্তু তিনি এসেছিলেন, হিমালয়ের পথে আমরা এসেছি সে খবর পেয়ে। তাঁর হাসি হাসি সৌম্য মুখটি আমার বেশ মনে পড়ে।

সেই সকালে রামগড়ে, হুঁকো দাদুর কাণ্ড কারখানায় আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেলেও পাণ্ডাজী কিন্তু অবাক হননি।ধীর স্থিতপ্রতিজ্ঞ।হ্যাঁ ও বলেন না , না ও বলেন না।

পাণ্ডাজী পরে বলে ছিলেন,এমন নাকি হয়। প্রতি বছরই ।এমন কেস । শেষ মুহূর্তে তাদের যাওয়া হয় না। দাদু কে ফেলে আমরা তৈরি হই,”জয় কেদার!”

সকাল বেলায় গায়ে জ্বর থাকায় ঠিক হল আমি ঘোড়ায় চেপে যাব। বাবা, মা সবাই চলে গেলে একটা কালো ঘোড়ায় চড়ে আমি একা একা চলতে শুরু করি কেদারের পথে। আমার পাশে এক বাহক। আগে আগে চলেছে ডান্ডি, কান্ডি ওয়ালারা, নিয়ে চলেছে অন্য দাদু দিদা দের।

এবার 'পাহাড় কো' মানে আমরা খাদের দিকে। বেশ গা ছম ছম অনুভূতি । কারণ ঘোড়ার মর্জির ওপর আমার হাত নেই। পা ফস্কালেই গভীর খাদ। ঘোড়ার পিঠে পা ছড়িয়ে বসে থাকতেও আমার বেশ অসুবিধা লাগছিল। এক সময়ে বাঁক ঘুরতেই ,” উ দেখো খোকি - বোল, জয় কেদার।” বলে উঠল পাহাড়ি লোকটি।

নদীর গা লাগা যে মন্দির সেদিন দেখেছিলাম তার সৌন্দর্য আমার শিশু হৃদয়ে ও গভীর রেখাপাত করেছিল। আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই। এত সুন্দর। কোন ক্যামেরা আমরা নিয়ে যাইনি। যা ধরে নিয়ে এসেছি তা শুধু স্মৃতিতে।

দো চালা মন্দিরটি সামনে রেখে দাঁড়িয়ে পিছনে আরেকটি চারচালা মন্দির। যেন শিব লিঙ্গের আঙ্গিক। বর-বৌ এর কনক অঞ্জলির ভঙ্গি। সেই ছবির মত।পিছনে, সাদা তুষার মৌলী হিমালয় । কিন্তু কাছের পাহাড় গুলি মস-সবুজ নরম চাদরে ঢাকা। সামনে মন্দাকিনী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। নুড়ি, পাথর,পাহাড় ডিঙিয়ে। কোথাও রঙ রূপোর পাতের মত ঝিলিক পারা, কোথাও সফেন বুদ্বুদ।সেই নদীতে অত শীতেও যাত্রীরা নেমেছে অবগাহনে।

দিদারা শাড়ির পাড় হাঁটু অবধি তুলে এগিয়ে গেলেন, জল মাথায় ছুঁতে। দেখাদেখি আমিও নামলাম। সেই জল গায়ে মেখে মনে হল আমার জ্বর চলে গেছে। এতক্ষণে বেশ রোদ উঠেছে। চার দিক সোনা ঝলমল।

মুখ তুলেই দেখি, দূরে রানা, সবার আগে। লাল সোয়েটার লাল টুপি মাথায়। কাঁধে ইস্কুল ব্যাগ। পিছনে মা আর বাবা। মেজ পিসিমা ও শিশি পিসি আগেই এসে পৌঁছেছেন।

সাধারণ বাঙ্গালী চাবি বাঁধা কায়দায় পরা শাড়ি,কে বলবে বাঙ্গালী নারী হাইক করতে পারেনা? ‘পথি নারী বিবর্জিতা’ চ্যালেঞ্জ করে যেন এঁরা সোচ্চার, ‘যে রাঁধে সে বুঝি চুল বাঁধে না?’

শিশি পিসি আজ খুব খুশি। বোতলের জল গুলি গুনে পেন দিয়ে লিখে রাখছেন,’জয় কেদার’। আমি নাড়াচাড়া করি,’রুদ্র প্রয়াগ’,'গুপ্ত কাশি’,'কুণ্ড' ইত্যাদি। শিশি গুলি আমার হাত থেকে তুলে সাজিয়ে রাখেন বাক্সটিতে।


সেদিন সন্ধ্যায় দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছিল। আমার জ্বরের জন্যই হয়ত বাবা মনস্থ করলেন আরতি দেখতে যাবেন না। আর সবাই গেল।একদন্ত দাদু বললেন,” সেকি কেমন মানুষ আপনি, মশাই? গলায় পইতেও তো দেখেছি। বাবার মন্দিরে এসে আরতি দেখবেন না?”

বাবা মুচকি হাসেন কিন্তু মাথা নাড়েন, "না।"

“ কেদার বাবার কাছে হাত জোড় করে যা চাইবেন, পাবেন।প্রার্থনা করবেন, তবে না!” একটি মাত্র দাঁত বার করে মিষ্টি হাসলেন দাদু। আমিও বলি,”যাও বাবা, আমি দিব্যি একলা থাকতে পারব।”

একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। পাথরের ওপর সেই নদীর কোলে বসে বাবা বললেন, “ঠাকুর তো এইখানে, রে।” বলে চারপাশে মাথা ঘুড়িয়ে দেখলেন। দেখালেন। দু হাত জোড় করে চোখ বুজে উচ্চারণ করলেন, "দত্তং মনোর্য দুপতে কৃপায় গৃহান।”

“মানে?" “মানে- আমার হৃদয়খানি দিতে এসেছি, তুমি তা কৃপা করে গ্রহণ কর।”


ফেরবার পথে, আমি একলা ঘোড়ায় যাব? রানার ও বোধহয় ইচ্ছা হল ব্যাপারটা কি জানার। তাকেও দেওয়া হল একটা ঘোড়া। সাদা ঘোড়া।

রামগড়ে ফিরে এসে দেখি হুঁকো দাদু ভালই আছেন। মুড়ি সুড়ি দিয়ে বসে গরম গরম চা খাচ্ছেন। দিদাকে দেখে বললেন, “দর্শন হইল?” দিদার চোখে করুণ ব্যথা, মাথা নাড়লেন কাঁধ ছুঁয়ে।

“তোমার চোখ দিয়াই আমার দ্যাখন হইল।” দাদু বললেন,” তিনি আমারে চান নাই। আমার কপালের লিখন।”


ফেরার পথে আমরা নাচতে নাচতে নামছি উৎরাই এর পথে। চড়াই ওঠা যাত্রীর দল হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করে," আর কতদূর?” বাবা বলতেন, “এই তো, বাঁক ঘুরলেই।জয় কেদার।”

আমার বাবাও মিথ্যা কথা বলেন! তাজ্জব হয়ে যাই।

পরে বুঝেছিলাম, এ মিথ্যাটা মিথ্যা নয়। ওটাই চরম সত্যি। এ পথের চড়াই ওঠার টনিক।


বদরী বিশাল যাবার পথের হাঁটা কেদারের মত অত সুদীর্ঘ ও দুর্গম লাগেনি। হয়ত ততদিনে আমরা খানিকটা ধাতস্থ ও হয়ে গেছিলাম। সে পথের একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে এ জার্নালটি শেষ করব।

একদিন হাঁটার পথে দেখলাম রাস্তা বানানর গাড়ি ও আর্মির লোক। আমাদের ওপর হঠাৎ হুকুম - "তফাৎ যাও।”

বাবা বেশ রেগে তর্ক করলেন,”আগে নোটিশ দাওনি কেন? আমরা পদযাত্রীর দল এখন কোথায় যাব? ডাকো তোমার ম্যানেজারকে।” ইত্যাদি।

লোকটা বলল,”সাব, ডাইনামাইট ফাটঙ্গে। আওড় আট মিনিটকে ওয়াক্ত। যাইয়ে।” বলেই সে যুদ্ধের সিনেমার সৈনিকের মত একটা পাথরের আড়ালে মুখ ঢেকে বসে পড়ল।দেখাদেখি আমরাও বড় বড় পাথরের আড়ালে আত্ম রক্ষা করি।

ঠিক আট মিনিটের মাথায় বিকট শব্দে পাহাড় ফাটল। সে কী শব্দ! তারপর পাথরের চাঙর গড়িয়ে পড়ল দূরে।

যে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম তাতে ছিল বিচুটির বন। বারিন জেঠুর ওষুধে খানিক শান্ত হলেও সে জ্বালায় ছটফট করেছি অনেকদিন।

বাবা বললেন,"এই শেষ। পরের বছর থেকে এ রাস্তায় বাস এসে যাবে। এ পথের মৃত্যু ঘটবে। দূরের ঐ ছোট ছোট মাটির চটিগুলোতে আর আলো জ্বলবে না। ঐ কমলা ওয়ালা, চায়ের দোকানের দোকানি, পাণ্ডাজীর ছেলেরা হয়ে যাবে বেকার। হয়ত রাস্তা বানাবার কুলি হয়ে যাবে। সরাই খানার কাঠের দরজা গুলো হাওয়ায় লটপট করবে। কেউ আসবে না সেখানে আশ্রয় নিতে, লেপ কম্বলের উষ্ণতার জন্য।

তখন হয়ত কেদারের মন্দিরের পাশে একটা ছোট পাব পাওয়া যাবে। হট ডগের স্ট্যান্ড, ছবির ফিল্মের দোকান আর সুভেনিরের স্টল। যেমন ম ব্ল্যাঙ্কের সামনে দেখা যায়, সুইৎজার ল্যান্ডে। কিন্তু এ পথের অনেক কিছুর মৃত্যু হবে।


এর পর, বহু বহু বছর পর সেখানে যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। ম ব্ল্যাংক দেখার সৌভাগ্য একটি ছোট সুইস গ্রাম-' শ্যাম্পুসেন ' থেকে। কী দেখছি, সে কথা বাবাকে বলার আর সুযোগ পাইনি।

আপনাদের বলে যাব একদিন।


২৭৬৩ শব্দ