Dita Basu - <!-- -->পর্তুগালঃ কইমব্রা বিশ্ব বিদ্যালয় আর জোয়ানিনা লাইব্রেরি

পর্তুগালঃ কইমব্রা বিশ্ব বিদ্যালয় আর জোয়ানিনা লাইব্রেরি


Joanina Library __ পর্তুগালঃ কইমব্রা বিশ্ববিদ্যালয়, জোয়ানিনা লাইব্রেরি ও একটি ঐতিহাসিক প্রেমের গল্প__

সাতশ বছরের পুরনো কইমব্রা ইউনিভার্সিটি যেমন একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরা তেমনি আধুনিক বৈশিষ্ট্যে উজ্বল। বিশাল বিল্ডিং গুলি আর্ট ডেকো কোনটা, কোনটা বা গথিক ছাঁদের।

পুরোনো কালচার যেন শুকিয়ে না যায় তার উদাহরণ দেখলাম — মেরামতের জন্য একটা বিল্ডিং এর অংশ বিশেষ বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেখানে কেমন করে পুরোনো টাইলের কাজ অপরিবর্তিত থাকবে তার ছবি এবং নোটিশ ঝুলছে। এরা এদের নিজস্ব কৃষ্টির সম্মান দেয় গর্ব ভরে।

বিশাল চত্বরে একটা ছায়া খুঁজে বসলাম। এখন কলেজের সেশন চলছে, ছাত্ররা ব্যস্ত ক্লাসে যেতে। কেউ কেউ টাই পরা এবং এই টাই য়ের রং দেখে নাকি বোঝা যায় কে কোন ফ্যাকালটির। মানে আইন বা ল এর রং লাল, এডুকেশন ও সাইকোলজি — কমলা, ইত্যাদি।

অনেক অনেক দিন আগে যখন ছাত্ররা এক গাদা বই নিয়ে চলা ফেরা করত তখন বিভাগ অনুযায়ী তাদের সেই রঙের ফিতে দেওয়া হত। এখন ও হয়। এই ফিতের আবার বিশেষ মূল্য।

কিন্তু গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের দিন নাকি এটি পুড়িয়ে ফেলা একটা রেওয়াজ।সেদিন টিন টেনে বাজিয়ে বেজায় আওয়াজ করে ছাত্ররা জাহির করে যে এবার তাদের ছাত্র জীবন শেষ, এবার তারা বড়দের জগতে প্রবেশ করছে। এ অনুষ্টান নাকি এত পপুলার যে দূর দূরান্ত ইয়েরোপের অন্যান্য দেশ থেকে পর্যন্ত ছাত্ররা আসে মজা দেখতে।

এইসব শুনছিলাম যে ভদ্রলোক আমার পাশে এসে বসলেন সিঁড়ির ওপর ছায়ার ভাগ নিতে তাঁর কাছ থেকে। দেখি, তাঁর পায়ে প্লাস্টার বাঁধা, হয়ত কোন আঘাতে । তাঁর অতিথিরা টিকিট কিনতে গেছে। অফিস ঘর আবার ঐ চড়াই ভাঙা পাহাড়ের ওপরে। অমিত ও গেছে সে কথা শুনে, কোথায় লাইব্রেরি দেখার টিকিট কিনতে পাওয়া যায় তার খোঁজে।

কইম্ব্রার জোয়ানিনা লাইব্রেরি একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিস। কয়েক শতকের পুরনো বই ও পুঁথি এখানে রাখা আছে, এবং তা কী করে সংরক্ষিত তা জানলে অবাক লাগে। সারা পৃথিবীর লোক লাইন লাগায় এই লাইব্রেরি দেখতে টিকিট কিনে।

জানা গেল এক সংগে ষাট জন মোটে যাবার ছাড়পত্র পাবে। থাকার মেয়াদ মাত্র কুড়ি মিনিট। আধ ঘন্টার বিরতি। তারপর আবার আরেক দল ছাড়পত্র পাবে। কোন কিছু ছোঁওয়া যাবে না। তবু অত ভীড়? কী এমন আছে দেখার? ভাবি। আবার ছবি তোলাও বারণ।

“তা হলে ছাত্ররা কোন লাইবরেরিতে যায়?” প্রশ্ন করি আমি।

“ঐ দূরে জেনেরাল লাইব্রেরি।” তার ব্যবস্থা যেকোন আধুনিক গ্রন্থাগারকে হার মানায়।

অবশেষে এল আমাদের প্রতীক্ষিত সময়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে, মাটির তলা দিয়ে পৌঁছলাম লাইব্রেরিতে। প্রথমে ঢুকে মনে হল গ্রামের কোন মাটির বাড়িতে ঢুকেছি বুঝি। অমন সোঁদা গন্ধ, আর বিশাল উঁচু উঁচু ধাপ। পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি, কিচছু নেই। প্রায় ঘুটঘুটি অন্ধকার।মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় বিভিন্ন ঘরে। না হলে ছাত ঠোক্কর দেয় মাথায়। ঘাড় গুঁজে বেরিয়ে আসি। শোনা গেল এটা হল শাস্তি পাওয়া ছাত্রদের জন্য জেলখানা।

লাইব্রেরির সংগে শাস্তি ও জেলখানা কথাটা আমার ভাল লাগল না। তারপর ওপর তলায় পৌঁছলাম যখন তখন তার জাকজমক দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

নানান দেশের বিশেষ করে প্রাচ্যের নানান অলংকরণ যা তারা দেখে এসেছে সেই সব দেশে গিয়ে, তা কাজে লাগান হয়েছে। ইতালিয়ান শ্রেষ্ট কারিগররা এসেছিল তাদের বিশিষ্ট হাতের কাজের সুবাদে। এল ব্রেজিলের সর্ব শ্রেষ্ট কাঠ আর সোনার গিলটির আলপনা দিয়ে তৈরী হল তাকগুলি।

মস্ত টেবিল পাতা বিশাল ঘরের মাঝখানে । তার ওপর রূপোর দোওয়াত। এক কালে থাকত কালি। শোনা গেল পনেরো শ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ২৫,০০০ মত বই আছে এখানে সংরক্ষিত এবং তার অনেক গুলিই হাতে লেখা।

এসব বই সংরক্ষনের জন্য বিশেষ যত্নবান এরা। লাইব্রেরি দরজা ব্রাজিলিয়ান ওক কাঠের । ভিতরে একটা আশ্চর্য সুন্দর মিঠে গন্ধ, খানিকটা ধূপের মত আবার বনের কাঠের গন্ধ মেশা। লোক ঢুকিয়েই সংগে সংগে দরজা বন্ধ করে দেয়, যাতে জলীয় হাওয়া না থেকে যায়।

এই পুরোন বই কেমন করে আগলে রাখে এরা পোকার হাত থেকে ?

বাদুর পুষে। রাত্তির বেলা তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় পোকা খাওয়ার জন্য। এইভাবে কোন কেমিকাল ব্যবহার না করে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক উপায়ে বইপোকা সমস্যার সমাধান করে এরা।

ছবি তোলা বারণ। যে ছবি দিলাম তা সংগৃহীত, আমার তোলা নয়।

শুনেছিলাম প্রথম বাংলা গদ্যের ইতিহাসের সংগে জড়িয়ে আছে পর্তুগালের নাম। যিনি লেখেন তাঁর নাম দম এন্টোনিও রোজারি। পর্তুগীজ নাম মনে হলেও তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। দম এন্টোনিওর সে বই কিন্তু পর্তুগীজ ভাষায় ছাপা হয়নি।তাঁর কথা বলব পরে।

সে নাম হয়ত আমরা তেমন জানিনা, যা জানা যায় তা, আরেক পর্তুগীজ মিশনারির নাম —ম্যানুয়েল দা আসামসাও এবং প্রকাশক ফ্রানসিসকো দা সিলভার কথা, আর এ বই প্রকাশ হয়েছিল ১৭৪৩ সালে, লিসবনে। লিসবনের বহু বই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে পরে।

সে বইটি কী তবে ওখানে আছ? ঐ তাকগুলির কোন খাপে? জানার উপায় নেই।

“এগিয়ে চল এগিয়ে চল” — শুনতে পেলাম আর দেখি মানুষের ভীড়ের ধাক্কায় কখন বাইরে এসে পড়েছি।


লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালে চোখে পড়বে অনেক বাড়ির ছাদ। বেশির ভাগ বাডিগুলির রং সাদা আর তাদের ছাদগুলি লাল রঙের টালির। একটা স্লেট নীল নদী সর্পিল আমেজে এঁকে বেঁকে চলে গেছে। তার ওপর একটা ব্রীজ । এত ওপর থেকে খেলা ঘরের মত দেখাচছে সব। ঐ দূরে একটা ক্যাথেডরালের চুড়ো। এর একটা গল্প আছে।

একটি প্রেমের গল্পঃ

ইনাস ও পেডরো

রোমিও জুলিয়েটের ও আগে ছিল কইমব্রার ইনাস আর পেডরোর প্রেম। শোনা যায় পরবর্তী যুগে তা না কি সেকসপিয়র কে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর যুগান্তকারী প্রেমের গল্পটি লিখতে। আর এই পর্তুগীজ গল্প কোন বানানো গল্প নয়, ঐতিহাসিক সত্য।

যুবরাজ পেডরোর তখন ২০ বছর বয়স। রাজা আলফানজো (পঞ্চম) স্থির করলেন ভাল ঘরের একটি মেয়ে কনস্ট্যান্স এর সংগে ছেলের বিয়ে দেওয়া যাক। এর পিছনে ছিল রাজনৈতিক কূটনীতি । কনস্ট্যান্সের সংগে এল সঙ্গিনী ইনাস। সে গ্যালিসিয়া দেশের মেয়ে যাদের সংগে তখন কার পর্তুগালের চেয়ে স্পেনের ঘনিষ্ঠতা বেশি। ষোড়শী ইনাস অপূর্ব সুন্দরী । অনেকেরই মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত রূপ। যুবরাজ পেডরোও বাদ পড়লেন না। দুজনেই পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ হলেন।

এদিকে পেডরোর সংগে বিয়ে হবার পর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কনস্ট্যান্স মারা যান। এখন তো রাস্তা খোলা। ইনাসের প্রতি গোপন প্রেম প্রকাশ করার সময় এসেছে মনে করলেন পেডরো। ইনাসকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকারোকতি দেওয়ার এখনই সময়।

রাজা আলফানজো ছেলের এই মনোভাব মোটেই ভাল চোখে দেখলেন না। এদিকে পেডরো প্রেমে হাবুডুবু। রোজ ইনাস কে চিঠি লেখেন আর তাঁদের দুজনের বাড়ির সামনে দিয়ে যে ছোট নদীটি বয়ে গেছে তাতে ভাসিয়ে দেন। প্রেমপত্র পাহাড়ি নদীর স্রোতে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে যায় ইনাসের কাছে।

যুবরাজ পেডরো আর না থাকতে পেরে কইমব্রায় বাস নিলেন। নিয়ে আসলেন তাঁর প্রেমিকাকে এবং গোপনে বিয়ে করে বসবাস শুরু করলেন। এখন তাঁদের চারটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে হয়েছে।

কিন্তু রাজা এ ও ভাল চোখে দেখলেন না। এরপর তো ঐ ইনাসের ছেলেরাই সিংহাসনের উত্তরাধিকার পাবে। তার মানে পর্তুগালের সংগে স্পেনের সম্পর্ক ঘোলাটে হয়ে যাবে। হয়ত স্পেনের আধিপত্য বাড়বে। এ হতে দেওয়া যায়না ভাবলেন রাজা আলফানজো । পেডরো রাজা হবার আগেই ঠিক করলেন ইনাস কে সরাতে হবে।ষড়যন্ত্র চলতে লাগল।

ইনাসকে হত্যা করা হল । আর শোনা যায় তাঁদের শিশু সন্তানদের সামনে সেই মর্মান্তিক হত্যাটি সম্পন্ন হয়েছিল। ইনাসের প্রার্থনার সে করুন দৃশ্যটিকে অপূর্ব রূপ দিয়েছেন পরবর্তী কালের শিল্পী, তাঁদের আঁকা ছবিতে।

পেডরো বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে উদ্যত হন, রানী মা তাঁকে তখনকার মত নিরস্ত করেন। কিন্তু যুবরাজ পেডরো সিংহাসনে আসীন হয়েই প্রথম যে কাজটি করেন তা মৃত ইনাসের শরীর কোনমতে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে রানীর মর্জাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া। যারা এই হত্যাকান্ডের সংগে জড়িত ছিল তাদের ইনাসের মৃত হাতে চুমু খাইয়ে ইনাসের রানির পদ মর্যাদা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। এরপর ঐ হত্যাকারীদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে তাদের বুক চিড়ে হৃৎপিন্ড বার করেন। এইজন্য তাঁর অবশ্য একটা নাম ইতিহাস না উল্লেখ করেই পারেনা —‘the cruel’ — নিষ্ঠুর ।

ইনাসের সমাধির সামনে, ঠিক তার মুখোমুখি এক সমাধি স্থাপন করেন পেডরো। যেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানে রাখা হয় তার ব্যবস্থা । এ জীবনে যা হল না, মৃত্যুর পর যেন তাঁরা মিলিত হতে পারেন।

শোনা যায়, কুইনটাস ডি লাগরি মার্স, যেখানে ইনাস খুন হন সেখানে পাথরের বুকে আজও ইনাসের রক্তের দাগ দেখা যায়। এত শত বছরেও কালের স্রোত তা ধুয়ে দিতে পারেনি। ঐ নদীর দুপাশে যে ঘাস জন্মায় তা যেন ইনাসের চুলের মত নরম সোনালি। আজও কান পাতলে সেখানের হাওয়ায় না কি তাঁদের প্রেমের গান ধুন শোনায়।

ইনাস আর পেডরোর প্রেমের ইতিহাস বানানো রোমানটিক গল্পকেও ছাড়িয়ে যায়। কত ছবি, গান, অপেরা যে রচিত হয়েছে এঁদের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে তা জানলে সত্যি তাক লেগে যায়।

E1BC8A25-2D8F-46AC-A18A-A34F2268ABAC